সাড়ে তিন কোটি টাকার পোস্টাল জালিয়াতি প্রতারক চক্রের ৬সদস্যকে গ্রেফতার র্যাব১
গত ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে ঢাকা জেনারেল পোস্ট অফিস (জিপিও)এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বুঝতে পারেন যে,একটি প্রতারক চক্র পোস্টাল মানি অর্ডার জাল করে অভিনব উপায়ে টাকা উত্তোলন করছে। কিš‘ প্রথমত তারা প্রতারক চক্রটিকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। গত জুন-জুলাই ২০২০ এর দিকে কয়েক হাজার জাল মানি অর্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়। শুধুমাত্র ঢাকা জিপিওতে এই রকম ৮,০০০ জাল মানি অর্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়াও মিরপুর এবং নিউমার্কেট পোস্ট অফিসেও এখন পর্যন্ত প্রায় সমসংখ্যক জাল মানি অর্ডারের সন্ধান পাওয়া যায়। সন্দেহভাজন প্রতারক হিসেবে জিপিও কর্তৃক জনৈক ফজলুল হক,আবুল বাশার এবং শিমু বেগমের নামে মামলা করা হয়। মামলা করার ফলে সন্দেহভাজন আসামীরা আত্মগোপনে চলে যায়।পরবর্তীতে এই বিষয়ে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে জিপিও কর্তৃপক্ষ র্যাবের নিকট অভিযোগ প্রদান করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় অদ্য ০৩ জানুয়ারি ২০২১ ইং তারিখ আনুমানিক ০৪৩০ ঘটিকায় র্যাব-১ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর আগারগাঁও থানাধীন তালতলা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে পোস্টাল সার্ভিসে প্রতারণা চক্রের মূলহোতা ১) মোঃ ফজুলল হক আশরাফ (৫২) ও তার স্ত্রী ২) মোসাঃ আছমা আক্তার শিমু (৩৮)’দ্বয়কে আটক করে। এসময় ধৃত আসামীদের নিকট হতে নগদ ১,৫০,০০০/- টাকা, জিপিও এর বিপুল পরিমাণ সিল এবং মানি অর্ডারের ফরম উদ্ধার করা হয়।
মূলত ধৃত আসামী মোঃ ফজুলল হক আশরাফ (৫২) প্রথম দিকে (২০১৮ সালে) পোস্টাল সার্ভিসের কতিপয় কর্মচারীর সহায়তায় মানি অর্ডারের টাকার পরিমাণ পরিবর্তন করে পোস্টাল সার্ভিসের সাথে জালিয়াতি শুরু করে।গ্রেফতারকৃত আসামী মোঃ ফজলুল হকের দেওয়া তথ্যমতে তিনি পথশিশু ফাউন্ডেশন, সানোয়ার ফাউন্ডেশন এবং এ্যারোলাইট বায়োগ্যাস নামক কতিপয় সংগঠনের প্রধান। তিনি পথশিশুদের উন্নয়নের জন্য তাদের দিয়ে কাগজের ঠোংগা বানিয়ে বিক্রয় করে থাকেন বলে প্রচার করে থাকেন। স্বল্পমূল্যে এই কাগজের অব্যাহত সরবরাহের জন্য তিনি প্রথমত সকল মাধ্যমিক ও উ”চ মাধ্যমিক বোর্ড চেয়ারম্যানদের নিকট চিঠি দেন। উক্ত ব্যক্তিদের কাছ হতে প্রতি উত্তর না পেয়ে মহামান্য হাইকোর্টে এক রিটের মাধ্যমে সমস্ত শিক্ষাবোর্ড হতে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার প্রতিটি খাতা ৬০ পয়সা মূল্যে ক্রয় করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন।সেমতে তিনি বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষকদের নিকট হতে ৬০০ টাকার বিনিময়ে ১০০০ খাতা কেনা শুরু করে। তখন সে জিপিও’র মানি অর্ডার ফরম জাল করে ৬০০ টাকা মূল্যের মানি অর্ডার বিভিন্ন শিক্ষকদের নামে পাঠাতে শুরু করে। আসল মানি অর্ডারের মত সই এবং সিল সম্বলিত নকল মানি অর্ডারগুলো কৌশলে জিপিওসহ বিভিন্ন পোস্ট অফিসে বিতরণ চ্যানেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। যথাযথ চ্যানেলের মাধ্যমে জাল মানি অর্ডারগুলো বিতরণ হওয়ায় ডেলিভারি পয়েন্ট থেকে কোনরূপ সন্দেহ প্রকাশ করা হয়নি। এছাড়াও তিনি এ্যারোলাইট বায়োগ্যাস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ই-কমার্সের”ক্যাশ অন ডেলিভারি”র আদলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের নিকট তথাকথিত জৈব সার পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। জৈব সার পাঠানোর এই প্রক্রিয়াতে তিনি পোস্টাল সার্ভিসের ভিপি পরবর্তীতে তিনি জৈব সারের ভু-য়া বিক্রি দেখিয়ে তার এ্যারোলাইট বায়োগ্যাসের নামে একই পদ্ধতিতে জাল মানি অর্ডারের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে শুরু করেন।পার্থক্য শুধু এটাই যে,এইবারে তিনি নিজেই মানি অর্ডারের প্রাপক।
এছাড়াও তিনি অধিক পরিমাণের মানি অর্ডারগুলো সরকারী খামের মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট মাস্টার বরাবর প্রেরণ করতেন। বেশকিছুদিন পূর্বে তিনি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানাধীন নাগরী পোস্ট অফিস থেকে প্রায় ৪৫০ চিঠি বিভিন্ন পোস্ট মাস্টার বরাবর প্রেরণ করেন। খামের ভেতরে বিভিন্ন অংকের জাল মানি অর্ডার ছিল। প্রতিটা খামে প্রেরকের জায়গায় তিনি নাগরী পোস্ট মাস্টারের সিল ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে নরসিংদী পোস্ট মাস্টারের নিকট প্রেরিত খামটি পোঁছালে তিনি খামগুলো ও মানি অর্ডার দেখে সন্দেহ করেন। কারণ মানি অর্ডার ফরম সাধারণত খামে প্রেরণ করা হয় না। তখন তিনি তার সন্দেহের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জানালে তারা তদন্ত করে জানতে পারেন যে, মানি অর্ডারগুলো জাল।এছাড়াও কৃষকদের সৌদি খেজুর গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণের জন্য সে প্রলোভন দেখায়। এর অংশ হিসেবে সে রেজিষ্ট্রেশন ফি বাবদ ১০০ টাকা ধার্য করে বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করে। একই সাথে তার প্রতিষ্ঠান পথশিশু কল্যাণ ট্রাস্ট এর পক্ষ থেকে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পোস্টাল অর্ডারের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে।
জিওপি মানি অর্ডার এবং অন্যান্য সিল ডাকটিকেট ইত্যাদি জালিয়াতির অভিযোগে মূলহোতা ১) মোঃ ফজুলল হক আশরাফ (৫২), পিতা- মৃত খোদা বক্স খলিফা, সাং- ধর্মদহ, থানা-দৌলতপুর, জেলা- কুষ্টিয়া ও তার স্ত্রী ২) মোসাঃ আছমা আক্তার শিমু (৩৮), উভয় বর্তমান ঠিকানা- ৬২/২ শহিদ জামিল রোড, তালতলা, থানা- আগারগাঁও, ডিএমপি, ঢাকা কে অদ্য ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ইং তারিখ ০৪৩০ ঘটিকায় রাজধানীর আঁগারগাও থেকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃত আসামীদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে জিপিও এর কিছু কর্মচারীর প্রত্যক্ষ সহযোগীতায় এই জালিয়াতি কাজটি হয়। পরবর্তীতে তাদের দেয়া তথ্যমতে অদ্য ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ইং তারিখ আনুমানিক ১৫০০ ঘটিকায় জিপিও এর ০৩ জন কর্মচারী এবং তাদের সহযোগী জন্য আরো ০১ জন সিভিলিয়ানকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন ১) মোঃ আমজাদ আলী (৫৫), পিতা- মৃত রজপ আলী খান, সাং- ৭৪ দেবী প্রশাধ চক্রবর্তী সড়ক, পূর্ব মিলপাড়া, থানা- সদর, জেলা- কুষ্টিয়া, বর্তমানে- মতিঝিল পোস্টাল কলোনী, বাসা নং- ৫/২, থানা- মতিঝিল, ডিএমপি, ঢাকা, ২) মোস্তাফিজুর রহমান (৫২), পিতা- মৃত আক্কাশ মিয়া, সাং- বালিয়াকান্দি, থানা- সেনবাগ, জেলা- নোয়াখালি, বর্তমানে- নিশ্চিন্তপুর, শাহী মহল্লা (আমতলী), থানা- ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ৩) ডলি রাণী সাহা (৫৩), পিতা- মৃত সামলাল সাহা, সাং- কুড়ালিয়া রোড, সাহা বাড়ি, সদর, চাঁদপুর, বর্তমানে- জি ১#৩/৩,পোস্টাল কলোনী, থানা- মতিঝিল, ডিএমপি, ঢাকা এবং সিভিলিয়ান ৪) লিংকন সাহা (২৪), পিতা- অরূপ সাহা, সাং-জি ১#৩/৩,পোস্টাল কলোনী, থানা- মতিঝিল, ডিএমপি, ঢাকা। এসময় ধৃত আসামীদের নিকট হতে প্রচারণার কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, স্ক্যানার, প্রিন্টার, জাল ডাকটিকেট, জাল মানি অর্ডার, বিভিন্ন জিওপি এর সিল ৪২ টি নগদ ১,৫০,০০০/- টাকা জালিয়াতির জন্য ব্যবহৃত অন্যান্য দ্রব্যাদি।